জান্নাতে পাওয়া যাবে, এমন কয়েকটি ফলের মধ্যে খেজুর একটি। এটি স্বাদে যেমন মিষ্টি তেমন অনেক পুষ্টিগুণে ভরপুরও বটে। আমাদের পবিত্র কোরআন শরীফেও খেজুরের কথা কয়েকবার উল্লেখ করা হয়েছে। আল্লাহ তা’আলা বলেন-
‘মানুষ তার খাদ্যের প্রতি লক্ষ্য করুক। আমিই প্রচুর বারি বর্ষণ করি। পরে আমি ভূমি প্রকৃষ্টরূপে বিদীর্ণ করি এবং আমি তাতে উৎপন্ন করি শস্য, আঙুর, শাক-সবজি, জাইতুন, খেজুর, বহু বৃক্ষবিশিষ্ট বাগান, ফল ও গবাদি খাদ্য। এটা তোমাদের ও তোমাদের জীবজন্তুর ভোগের জন্য।’ (সুরা আবাসা : আয়াত ২৪-৩২)
এই আয়াতের মাধ্যমে আমাদেরকে অন্যান্য আহারের সাথে খেজুর ভোগ করার কথা বলা হয়েছে। এটি আল্লাহর নিয়ামতের একাংশ যা খেলে আমাদের উপকার হবে। কিন্তু খেজুর খাওয়ার অভ্যাস আমাদের মাঝে খুব কমই দেখা যায়। শুধু রমজান মাস ছাড়া তেমন একটা খেজুর খাওয়া হয় না। আমরা যদি খেজুরের গুণাগুণ সম্পর্কে জানতাম তাহলে নিয়মিত খেজুর খাওয়ার অভ্যাস গড়ে নিতাম। তাই খেজুর নিয়ে আরেকটূ বিষদ ভাবে জানতে আজকের এই লেখা।
ইসলামে খেজুরের ইতিকথা
বিশ্বনবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সর্বদাই মানুষদের রোগব্যাধি থেকে সুস্থতা লাভের দিক-নির্দেশনা দিয়েছেন। কোন সাহাবি যখন অসুস্থ হয়ে পড়তেন তখন তিনি তাদের দেখতে যেতেন। তাদের শরীরে হাত বুলিয়ে দিতেন। তাদের সুস্থতার জন্য দোয়া করতেন এবং সুস্থতা লাভের জন্য খেজুর খাওয়ার পরামর্শ দিতেন।
মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) তার একটি হাদিসেআব্দুল্লাহ বিন উমরের (রাঃ) কে জিজ্ঞেস করেছিলেন, “গাছের মধ্যে একটি গাছ আছে যা একটি মুসলিম অনুরূপ। তার পাতা পড়ে না। ঐ গাছটা কি?” নবীজি (সাঃ) নিজেই বলেছিলেন, “এটাই খেজুর গাছ।
এর মর্মার্থ হচ্ছে, খেজুর গাছ অনেকটা মুসলিম জাতির ন্যায়। সে জাতির ধর্মের প্রতি যেমন কোন নড়চড় হয় না, তেমন খেজুর গাছেরও পাতা নড়ে না। সে জাতি যেমন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জাতি, তেমন খেজুরও সর্বোৎকৃষ্ট খাবার। আর সেই জাতির উপকারের জন্যই আল্লাহ তা’আলা এর এই নিয়ামত।
খেজুরের ধরণ
খেজুর, আরবিতে যাকে বলা হয় তুমুর। সৌদি আরবে রয়েছে নানা জাতের খেজুর। নামও বিভিন্ন। যেমন- আজওয়া, মরিয়ম, আম্বার, সাগি, সাফাওয়ি, মুসকানি, খালাস, ওয়াসালি, বেরহি, শালাবি, দাবাস, ডেইরি, মাবরুম, ওয়ান্নাহ, সেফরি, সুক্কারি, খুদরি ইত্যাদি। যদিও এখন পাকিস্তান, ইরাক, আলজেরিয়া, মিশর, ইরানসহ অনেক দেশে খেজুরের চাষ হয়, তবে মদিনার খেজুরকেই সর্বোত্তম খেজুর ধরা হয়। আর এসকল খেজুরের মধ্যে সর্বোৎকৃষ্ট হল আজওয়া ও মরিয়ম খেজুর।
পবিত্র মদিনার ভূমিতে যে আজওয়া খেজুরের উৎপত্তি , তার উপকারিতা সম্পর্কে স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এরশাদ করেন, “যে ব্যক্তি প্রতিদিন সকালে সাতটি আজওয়া খেজুর খাবে সেদিন বিষ ও যাদু তার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না।” (বুখারি)
মহানবী (সাঃ) এর বর্ণিত এই বাণী থেকে আমরা স্পষ্টতই বুঝতে পারি যে আজওয়া খেজুরের উপকারিতা কতটা বিস্তৃত। এই ফল সেবনে যেমন কোন প্রকার খারাপ জিনিসের প্রভাব আমাদের ওপর পরবে না, তেমন ছোট-বড় নানা রোগ-বালাই থেকেও রক্ষা করবে। শুধু আজওয়া খেজুর নয়, অন্যান্য খেজুরেও উপকারিতা রয়েছে বলে বিজ্ঞ আলেম ও পুষ্টিবিদগণ জানিয়েছেন। তবে তন্মধ্যে আজওয়া উৎকৃষ্ট। এটি ছোট-বড় নানা রোগের নিরাময় হিসেবে কাজ করে। প্রাচীনকাল থেকে এখন অব্দি বিশেষত হৃদরোগ নিরাময়ে খেজুরের ভূমিকা লক্ষণীয়। এটি শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। এছাড়াও খেজুর আমাদের শরীরের নানা পুষ্টি ঘাটতি পূরণ করে সুস্বাস্থ্য অর্জনে সহায়তা করে।
খেজুরের বিদ্যমান উপাদানসমূহ
খেজুরে প্রায় সবধরণের খাদ্য উপাদান রয়েছে যা আমাদের দেহে সার্বিকভাবে পুষ্টির যোগান দেয়। এসকল খাদ্য উপাদানগুলো হল – প্রোটিন, ভিটামিন (এ, বি১, বি২, বি৪, বি৫, বি৬, বি৯, সি, ই, কে) কার্বোহাইড্রেট, বেটা ক্যারোটিন লুটিন জিজানথেন, ক্যালরি, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, সোডিয়াম, আয়রণসহ আরও অনেক। খেজুর একজন সুস্থ মানুষের শরীরে আয়রনের চাহিদার প্রায় ১১ ভাগই পূরণ করে। তাই প্রতিদিন খেজুর খাওয়া উচিত।
একনজরে খেজুরের উপকারিতা
১। খেজুরে থাকা বিভিন্ন পুষ্টি উপাদান সেরোটোনিন নামক হরমোন উৎপাদন করতে সহায়তা করে। যা মানুষকে মানসিক প্রফুলতা দেয় এবং মন ভাল রাখতে সহায়তা করে।
২। খেজুর শরীরে গ্লূকোজ এর ঘাটতি পূরণ করে শক্তি বৃদ্ধি করে।
৩। শরীরে রক্ত শূণ্যতা পূরণে খেজুরে থাকা আয়রন ভাল উপকারে আসে।
৪। ফুসফুসের সুরক্ষার পাশাপাশি মুখগহ্বরের ক্যান্সার রোধ করতে খেজুর অত্যন্ত কার্যকর।
৫। খেজুরে বিদ্যমান ডায়েটরি ফাইবার কলেস্টোরেল নিয়ন্ত্রণে রাখতে সহায়তা করে।
৬। পেটের গ্যাস, শ্লেষ্মা, কফ, শুষ্ক কাশি এবং এজমা রোধে খেজুর অনেক উপকারী।
৭। খেজুর মস্তিষ্ককে প্রাণবন্ত রাখে এবং স্নায়ুবিক শক্তি বৃদ্ধি করে।
৮। খেজুর এ প্রচুর পরিমাণ ক্যালরি থাকে। ফলে যারা অল্প পরিশ্রমেই দুর্বল হয়ে যায়, তাদের জন্য খেজুর একটি উৎকৃষ্ট পথ্য।
৯। খেজুর পানিশূন্যতা বা ডিহাইড্রেশন দূর করতে সাহায্য করে ।
১০। খেজুরের ক্যালসিয়াম দেহের হাড় ও দাঁতের মাড়ি মজবুত করে।
১১। খেজুরে থাকা ভিটামিন-এ এবং ভিটামিন-সি দৃষ্টিশক্তি ভালো রাখতে সহায়তা করে।
১২। খাদ্যে অরুচি দূর করতে মরিয়ম ব্যাপক সহায়তা করে।
১৩। খেজুরের স্যলুবল এবং ইনস্যলুবল ফাইবার এবং বিভিন্ন অ্যামিনো এসিড হজম প্রক্রিয়া ভাল রাখে।
১৪। খেজুরে থাকা ফাইবার কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে সহায়তা করে।
১৫। খেজুরে থাকা নানা পুষ্টি উপাদান ত্বক ও চুলের সুস্বাস্থ্য বজায় রেখে দীর্ঘদিন তারুণ্য ধরে রাখতে সহায়তা করে।
সতর্কতা
খেজুরেরই বেশির ভাগ অংশ জুড়ে চিনি থাকে। তাই যাদের ডায়াবেটিস রয়েছে, তাদের চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী খেজুর খাওয়া উচিত। অনেক ক্ষেত্রে ডায়াবেটিস থাকলে প্রচলিত খেজুরের বদলে শুকনো খেজুরকে ডায়েটে রাখতে বলেন বিশেষজ্ঞরা
পরিশেষে
পবিত্র মাহে রমজানে, সেহেরি হোক বা ইফতারে, খেজুর ছাড়া খাবারে তৃপ্তি আসে না। এছাড়া মদিনার এই উৎকৃষ্ট ফল, সারাদিন রোজা রাখার জন্য ও রোজা রাখার পরে পর্যাপ্ত শক্তির যোগান দেয়। তাই রমজান মাসে নিয়মিত খেজুর খাওয়ার পাশাপাশি সারা বছর এই উপকারী জান্নাতি ফলটি খাওয়ার অভ্যাস গড়ে ফেলতে হবে। তবেই পরিবার পরিজন নিয়ে সুস্থ থাকা যাবে এবং আল্লাহর নিকট শুকরিয়া আদায় করা সম্ভব হবে। আল্লাহ তা’আলা আমাদের সকলের রোজা ও ত্যাগ কবুল করে নিন। আমিন।